উইনি-তো-পু

লেখা এ-এ-মিলনে, ছবি ই-এইচ-শেপার্ড

মা'কে
হাতে হাত ধরে আসি
ক্রিস্টফার আর আমি
বইটা তোমায় দিতে।
তুমি কি চমকে গেছ?
তোমার লেগেছে ভালো?
এটাই চাইতে তুমি?
তাহলে তোমারি এটা!
কারণ আমরা তোমাকেই ভালোবাসি।

ভূমিকা

তুমি হয়তো ক্রিস্টফার রবিনের ব্যাপারে আগে অন্য একটা বই পড়েছিলে, তাহলে তোমার হয়তো মনে আছে যে ওর একটা রাজহাঁস ছিল (বা হতে পারে রাজহাঁসের ক্রিস্টফার রবিন ছিল, ঠিক মনে পড়ে না) আর সেই রাজহাঁসকে ক্রিস্টফার পু বলে ডাকতো। সে অনেক দিন আগের কথা, তারপর তাকে আমরা টাটা বলেছিলাম, কিন্তু নামটা আমাদের সঙ্গেই রেখে দিয়েছিলাম, ভেবেছিলাম রাজহাঁসের নিশ্চই আর সে নামের প্রয়োজন পড়বে না। তারপরে একদিন এডয়ার্ড ভালু যখন বলল ওরও একটা যমকালো নাম চাই, ক্রিস্টফার রবিন এক কথায়, নির্দ্বিধায়, এক মুহূর্তের জন্যও না ভেবে, নাম দিয়ে দিল উইনি-তো-পু। ব্যাস, হয়ে গেল। এটা হল পু নামকরণের বৃত্তান্ত, এবার বাকিটাও বলি।

লণ্ডনে থাকলে চিড়িয়াখানায় তো যেতেই হয়। কিছু লোক আছে যারা চিড়িয়াখানায় গিয়ে শুরু থেকে শুরু করে, প্রবেশপথ ধরে ঢোকে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সবকটা খাঁচা ঘুরে প্রস্থানপথ ধরে বেরিয়ে যায়। কিন্তু যারা ভালো, তারা এক ছুটে তাদের নিজেদের পছন্দের পশুর কাছে চলে যায়, আর সারাদিন সেখানেই থাকে। তাই ক্রিস্টফার রবিন চিড়িয়াখানায় গেলে সোজা যায় মেরুভালুকের কাছে, ফিসফিস করে তার চেনা এক পশুপালকের (বাঁদিক থেকে তৃতীয়জন) কানে কানে কিছু বলে, একটা লুকোনো দরজা খুলে যায়, আমরা অন্ধকার সুড়ঙ্গ আর লম্বা সিঁড়ি পেরিয়ে একটা বিশেষ খাঁচার কাছে চলে আসি, সেই খাঁচার দরজাও খুলে যায়, বেরিয়ে আসে ক্রিস্টফারের লোমশ খয়েরী বন্ধু, আর "ভালু" বলে এক ছুটে ক্রিস্টফার জড়িয়ে ধরে তাকে। এবার এই ভালুটার নামও উইনি (যাতে প্রমাণ হয় ভাল্লুকদের জন্য উইনি কি চমৎকার একটা নাম), কিন্তু মজার ব্যাপারটা হল কি, আমাদের ঠিক মনে নেই উইনির থেকে পু-র নামকরণ হয়েছে, না পু-র থেকে উইনির। কোনো এক কালে জানতাম, এখন ভুলে গেছি।

এত অবধি লিখেছি, তখনি হঠাৎ শুয়োছানা সরু গলায় শুধোলো, "আর আমি?" "ওরে আমার শুয়োছানা," আমি বললাম, "পুরো বইটাই তো তোকে নিয়ে।" "না, এটা তো পু-কে নিয়ে," উত্তর আসে। বোঝো কাণ্ড। শুয়োছানার রাগ হয়েছে কারণ পু-র জন্য এতটা ভূমিকা লিখেছি যে। পু অবশ্যই প্রিয়তম, নিঃসন্দেহে, কিন্তু শুয়োছানারও নিজস্ব কিছু স্থান আছে, যেখানে পু যেতে পারে না; যেমন পু-কে নিয়ে তো আর স্কুলে যাওয়া যায় না, কিন্তু শুয়োছানা এতটাই ছোটো যে টুক করে পকেটে ঢুকে যায়, আর যখন ক্রিস্টফার রবিন ঠিক ঠাওর করে উঠতে পারে না সাত দুগুণে বারো না বাইশ, তখন পকেটের ওপর দিয়ে শুয়োছানাকে হাত বুলিয়ে আদর করতে বেশ লাগে। মাঝেমধ্যে শুয়োছানা পকেট থেকে মুখ বার করে দোয়াতে মুখ দেয়, আর এ ভাবেই শুয়োছানার পু-র থেকে ঢের বেশি শিক্ষালাভ হয়েছে, অবশ্য পু তাতে দুঃখ পায় না। কিছু লোকের বুদ্ধি আছে, কিছু লোকের নেই, সে বলে, ব্যাস এতটাই।

এখন দেখি বাকিরাও বলতে শুরু করেছে, "আর আমরা, আমাদের কী হবে?" তাহলে বোধ করি আর ভূমিকা না লিখে এবার আসল গল্প লেখা যাক।

সূচী

পর্ব ১

যেখানে উইনি-তো-পু-র সাথে আমাদের প্রথম আলাপ, কিছু মৌমাছি, আর গল্পের শুরু

এই যে উইনি-তো-পু, ক্রিস্টফার রবিনের সাথে সিঁড়ি দিয়ে নামছে, মাথাটা সিঁড়িতে লাগছে ধুপ্, ধাপ্, ধপাস্। ওর যতদূর ধারণা, সিঁড়ি দিয়ে নামার এটাই একমাত্র উপায়, কিন্তু তবুও কেন জানি না মনে হয় অন্য কোনো উপায়ও থাকতে পারে, শুধু একবার যদি মাথা বাঁচিয়ে ঠাণ্ডা মাথায় একটু ভাবা যেত। তারপর আবার ভাবে, না হয়তো সত্যিই আর কোনো উপায় নেই। যাই হোক, এই সে পৌঁছে গেছে একতলায়, তোমাদের সাথে আলাপ করিয়ে দি এবার, উইনি-তো-পু।

আমি যখন প্রথমবার ওর নাম শুনলাম, আমি বললাম (ঠিক যেমন তুমিও ভাবছো), "কিন্তু আমার তো ধারণা ছিল ও একটা ছেলে?"

"ঠিক তাই," বলে ক্রিস্টফার রবিন।

"তাহলে উইনি নাম কী করে হল? ওটা তো মেয়েদের নাম।"

"ওর নাম তো উইনি নয়।"

"কিন্তু তুই তো বললি——"

"ওর নাম উইনি-তো-পু। তুমি 'তো' মানে জানো না?"

"ওহো হ্যাঁ, এবার বুঝেছি," আমি তাড়াতাড়ি উত্তর দি। আশা রাখি তুমিও বুঝেছ, কারণ এ ব্যাপারে এর বেশি বোঝাতে পারবো না।

কিছু কিছু দিন উইনি-তো-পু একতলায় এসে দাবা বা লুডো খেলতে চায়, আর অন্য দিনগুলোতে চুপ করে আগুনের সামনে বসে থাকে, গল্প শুনতে চায়। আজ সন্ধ্যেবেলায়——

"একটা গল্প হবে কি?" ক্রিস্টফার রবিন প্রশ্ন করে।

"হবে কি? কী রকম গল্প?" আমি উত্তর দি।

"তুমি কি উইনি-তো-পু-কে একটা মিষ্টি গল্প বলতে পারবে?"

"হয়তো," আমি বলি। "ওর কেমন গল্প ভালো লাগে?"

"নিজের ব্যাপারের গল্প ভালো লাগে, ও ওরকমই।"

"ও আচ্ছা।"

"তো বলতে পারবে, একটা মিষ্টি গল্প?"

"চেষ্টা করতে পারি," আমি বলি।

তাই চেষ্টা করলাম।

অনেক অনেক কাল আগে, এই ধরো গত শুক্রবার, স্যাণ্ডার্স নাম নিয়ে উইনি-তো-পু একটা প্রকাণ্ড অরণ্যে থাকত।

("নাম নিয়ে থাকত মানে?" ক্রিস্টফার রবিন প্রশ্ন করে।

"মানে ওর কাছে নামটা ছিল, সোনার অক্ষরে, দরজার ওপরে ঝোলানো, আর তার তলায় ও থাকত।"

"উইনি-তো-পু নাম নিয়ে দোটানায় ছিল," ক্রিস্টফার রবিন বলে।

"এখন আর নই," একটা রাগী গর্জন শোনা যায়।

"তাহলে আমি বাকিটা বলি," আমি বললাম।)

ও একদিন অরণ্যে হাঁটতে হাঁটতে একটা খোলা মাঠে এসে পৌঁছেছে, তার মাঝে একটা বিশাল সেগুন গাছ, আর গাছের ওপর থেকে আসছে একটা ভোঁ ভোঁ শব্দ।

উইনি-তো-পু গাছের তলায় বসে, দুটো হাতে মাথা গুঁজে, ভাবতে শুরু করল।

প্রথমে ও নিজেকে বোঝাল: "ঐ ভোঁ ভোঁ আওয়াজটার নিশ্চই কোনো একটা মানে আছে। কোনো মানে ছাড়া এমনি এমনি তো আর ভোঁ ভোঁ হয় না। ভোঁ ভোঁ হচ্ছে মানে কেউ ভোঁ ভোঁ করছে আর, আমার যতদূর জানা, কারুর ভোঁ ভোঁ করার একমাত্র কারণ হল সে একটা মৌমাছি।"

তারপর আরো অনেকক্ষণ ভেবে নিজেকে বোঝাল: "আর কারুর মৌমাছি হওয়ার একমাত্র কারণ, আমার যতদূর জানা, যাতে সে মধু বানাতে পারে।"

ও সঙ্গে সঙ্গে উঠে বলল: "আর মধু বানানোর একমাত্র কারণ যাতে আমি খেতে পারি।" আর তাই গাছে চড়তে শুরু করল।

ও চড়ছে আর চড়ছে আর চড়ছে, আর চড়তে চড়তে একটা গান গাইছে। গানটা এরকম:

ভালু ভালোবাসে মধু,
আমি সেটা ভাবি শুধু।
ভোঁ ভোঁ ভোঁ!
ভালো লাগবেই তো!

তারপর আর একটু উঠেছে ... আরো একটু ... তারপর আরো একটু। এতক্ষণে অন্য একটা গান মাথায় এসে গেছে।

ভারী মজা হত যদি মৌমাছি ভালু হত,
গাছের তলায় বানাত তারা মৌচাকগুলো যত।
আর তাই যদি হত (মানে মৌমাছি ভালু),
চড়তে হত না আমাদের এই লম্বা গাছগুলো।

ও এতক্ষণে বেশ ক্লান্ত হয়ে গেছে, তাই এরকম নিরাশার গান গাইছিল। কিন্তু ও প্রায় পৌঁছে গেছে, এবার যদি ঐ শেষ ডালটায় দাঁড়ায় ...

খটাস!

"বাঁচাও!" পু চেঁচায়, দশ ফুট তলার ডালে পড়তে পড়তে।

"ইস, শুধু যদি আমি——" পু বলে, ছিটকে কুড়ি ফুট তলার ডালে পড়তে পড়তে।

"মানে, যেটা আমি বলতে চাইছিলাম," পু বোঝায়, ঘাড় মাথা উলটে তিরিশ ফুট তলার ডালে পড়তে পড়তে, "মানে, তার মানেটা হল, মানে——"

"অবশ্যই, ওটা অনেকটা——" পু স্বীকার করে, হুশ হুশ করে পরবর্তী ছটা ডালের মধ্যে দিয়ে পড়তে পড়তে।

"যাই হোক, পুরোটাই আদ্যোপান্ত," পু বোঝে, শেষ ডালকে বিদায় জানিয়ে তিনটে চক্কর দিয়ে কাঁটাঝোপে নামবার ঠিক আগে, "মধু ভালোবাসার ফল। বাঁচাও!"

কাঁটাঝোপ থেকে পু বেরোল, নাক থেকে কাঁটাগুলো বার করল, আর আবার ভাবতে বসল। প্রথমেই ভাবল ক্রিস্টফার রবিনের কথা।

("আমার কথা?" ক্রিস্টফার রবিন প্রশ্ন করে, বিস্মিতনয়নে।

"হ্যাঁ, তোর কথা।"

ক্রিস্টফার রবিন আর কিছু বলে না, কেবল তার মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, আঁখি বিস্ফারিত হয়।)

তাই উইনি-তো-পু গেল ওর বন্ধু ক্রিস্টফার রবিনের বাড়ি, সে বাড়ি অরণ্যের অন্য এক প্রান্তে, একটা সবুজ দরজা দেওয়া বাড়ি।

"সুপ্রভাত ক্রিস্টফার রবিন," সে বলে।

"সুপ্রভাত উইনি-তো-পু," তুই বলিস।

"আমি ভাবছিলাম, তোমার কাছে কি কোনো বেলুন আছে?"

"বেলুন?"

"হ্যাঁ বেলুন। আমি আসতে আসতে মনে মনে ভাবছিলাম: 'ক্রিস্টাফার রবিনের কাছে কি কোনো বেলুন আছে?' আমি শুধু মনে মনে ভাবছিলাম, বেলুনের কথা মাথায় এল, তাই ভাবছিলাম।"

"বেলুন দিয়ে কী হবে?" তুই প্রশ্ন করলি।

উইনি-তো-পু চারদিকে দেখে নেয় কেউ শুনছে কি না, তারপর মুখের কাছে হাত নিয়ে ফিসফিস করে বলে, "মধু!"

"কিন্তু বেলুন দিয়ে তো মধু হয় না!"

"মাঝে মাঝে হয়," পু বলে।

এখন মজার ব্যাপারটা হল কি, গতকালই তুই তোর বন্ধু শুয়োছানার বাড়িতে একটা অনুষ্ঠানে গেছিলি, আর সেখানে অনেক বেলুন ছিল। তুই বড় সবুজ বেলুনটা নিয়েছিলি আর খগ্গোর একটা আত্মীয় বড় নীল বেলুনটা নিয়েছিল, কিন্তু সেটা ফেলে গেছিল, সে বড়ই বাচ্ছা; তাই তুই তোর সবুজ বেলুনটা আর ঐ নীল বেলুনটা বাড়ি নিয়ে এসেছিলি।

"কোনটা নিবি?" তুই পু-কে প্রশ্ন করিস।

দুটো হাতের মধ্যে মাথা গুঁজে সে অনেকক্ষণ ভাবে।

"মানে ব্যাপারটা হল," সে ভেবে বলে, "যখন বেলুন নিয়ে মধুর উদ্দেশ্যে যেতে হয়, আসল উদ্দেশ্য হল মৌমাছিরা যাতে টের না পায় যে তুমি আসছ। যদি সবুজ বেলুন হয়, ওরা ভাববে তুমি গাছ, আর যদি নীল বেলুন হয়, ওরা ভাববে তুমি আকাশ, কিন্তু কথাটা হল, এই দুটোর মধ্যে কোনটা করা যায়?"

"ওরা বেলুনের তলায় তোকে দেখতে পাবে না?" তুই প্রশ্ন করলি।

"পেতেও পারে, আবার নাও পেতে পারে," উইনি-তো-পু বলে। "মৌমাছিদের ব্যাপারে বলা শক্ত।" তারপর একটু ভেবে বলল: "আমি একটা কালো মেঘ হয়ে যাবো। তাহলে ওরা চিনতে পারবে না।"

"তাহলে নীল বেলুনটাই নে," তুই বলিস; আর তাই ঠিক হয়।

তো তোরা দু'জনেই নীল বেলুনটা নিয়ে বেরোলি, আর তুই তোর বন্দুকটাও সঙ্গে নিলি, মানে যেমন তুই নিস, আর উইনি-তো-পু ওর চেনা একটা প্রচণ্ড কাদার গর্তে গেল, আর তাতে ভালো করে গড়িয়ে অনেকটা কাদা মেখে পুরো কালো হয়ে গেল; আর তারপর, যখন বেলুনটা ফুলে বিশাল হয়ে গেল, তুই আর পু দু'জনেই সুতো ধরেছিলি, কিন্তু তুই চট করে সুতোটা ছেড়ে দিলি, আর পু ভালু আকাশে উড়ে গেল, আর সেখানেই রইল—গাছের মাথার সমানে, কুড়ি ফুট মতো দূরে।

"সাবাশ!" তুই লাফিয়ে বললি।

"বেশ ভালো, তাই না?" উইনি-তো-পু নীচে তোর দিকে তাকিয়ে বলল। "আমায় কেমন লাগছে?"

"দেখে মনে হচ্ছে একটা ভালু বেলুন ধরে আছে," তুই বললি।

"নাকি" পু করুণ দৃষ্টিতে বলে, "—আকাশে একটা ছোট কালো মেঘের মত লাগছে?"

"অতটাও লাগছে না।"

"আচ্ছা বেশ, হতে পারে এখান থেকে অন্যরকম লাগছে। তাছাড়া, আমি যেটা মনে করি, মৌমাছিদের ব্যাপারে বলা শক্ত।"

কোনো বাতাস বইছে না যাতে পু গাছের দিকে যেতে পারে, তাই ও ওখানেই রইল। মধু দেখতে পারছে, মধু শুঁকতে পারছে, কিন্তু ঠিক মধু অবধি পৌঁছতে পারছে না।

খানিকক্ষণ বাদে আবার তোর দিকে তাকিয়ে ডাকল।

"ক্রিস্টফার রবিন!" জোরে ফিসফিস করে বলল।

"বল!"

"আমার মনে হয় মৌমাছিগুলো কিছু সন্দেহ করছে!"

"কীরকম সন্দেহ?"

"জানি না। কিন্তু কেন জানি না মনে হচ্ছে ওরা সন্দেহ করছে!"

"হয়তো ওরা ভাবছে তুই ওদের মধু চুরি করতে গেছিস।"

"হতে পারে। মৌমাছিদের ব্যাপারে বলা শক্ত।"

আবার খানিকক্ষণ নিস্তব্ধতা, তারপর আবার তোকে ডাকল।

"ক্রিস্টফার রবিন!"

"হ্যাঁ?"

"তোমার বাড়িতে কি ছাতা আছে?"

"আছে বোধ হয়।"

"তাহলে ঐ ছাতাটা নিয়ে এসে, তুমি যদি একটু ছাতা ধরে পায়চারি করতে, আর মাঝে মাঝে আমার দিকে তাকিয়ে বলতে, 'ইস, মনে হচ্ছে বৃষ্টি হবে।' তুমি এটুকু যদি করতে, আমার মনে হয় মৌমাছিগুলোকে বোকা বানাতে একটু সুবিধে হত।"

তুই মনে মনে ভাবলি, "ধুস, বোকা ভালু!" কিন্তু মুখে কিছু বললি না, কারণ তুই ওকে এতটাই ভালোবাসিস, তাই তুই ছাতা আনতে বাড়ি ফিরলি।

"এই তো তুমি এসে গেছ!" তুই ফেরত আসা মাত্রই উইনি-তো-পু বলে। "আমার চিন্তা হচ্ছিল। আমি এতক্ষণে বুঝেছি, মৌমাছিগুলো অবশ্যই সন্দেহ করছে।"

"ছাতা খুলি?" তুই বললি।

"হ্যাঁ, কিন্তু একটু দাঁড়াও। আমাদের চিন্তাভাবনা করে কাজ করতে হবে। প্রধান মৌমাছি হল ওদের রাণী। তুমি ওখান থেকে রাণী মৌমাছিটাকে দেখতে পারছ?"

"না।"

"এঃ বাবা, আচ্ছা ঠিক আছে, তুমি যদি একটু ছাতা হাতে পায়চারি কর, 'ইস, মনে হচ্ছে বৃষ্টি হবে' বলতে বলতে, আর আমি যদি একটা মেঘের গান গাই, মানে মেঘেরা যেমন গায় ....!"

তাই তুই ছাতা হাতে পায়চারি করলি, আর ভাবতে থাকলি বৃষ্টি হবে কিনা, আর উইনি-তো-পু গান গাইতে শুরু করল:

মেঘ হওয়া মজা ভারি
নীলাকাশে তার বাড়ি!
মেঘ তাই সুর তুলে
গান গায় গলা খুলে।
"মেঘ হওয়া মজা ভারি
নীলাকাশে তার বাড়ি!"
মেঘ তাই সব ভুলে
ভেসে চলে মাথা তুলে।

মৌমাছিগুলো তখনো বেশ সন্দেহ করছিল আর ভোঁ ভোঁ করে ঘুরছিল। এমনকি, কেউ কেউ তাদের মৌচাক ছেড়ে মেঘের চারদিকে ঘুরছিল, আর মেঘটা যখন গানের দ্বিতীয় অংশটা শুরু করল, একটা মৌমাছি মেঘের নাকের ওপরে বসল, তারপর আবার উড়ে গেল।

"ক্রিস্টফার—আউ!—রবিন," মেঘটা চেঁচিয়ে ডাকে।

"কী?"

"আমি একটু ভাবলাম, আর ভেবে একটা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি। এগুলো ভুল ধরণের মৌমাছি।"

"বটে?"

"হ্যাঁ, বেশ ভুল ধরণের মৌমাছি। তাই আমার মনে হয় ওরা ভুল ধরণের মধু বানাবে, তোমার কী মনে হয়?"

"ভুল ধরণের মধু বানাবে?"

"হ্যাঁ। তাই আমার মনে হয় আমি নীচে নেমে আসব।"

"কী করে?" তুই প্রশ্ন করিস।

উইনি-তো-পু এটা ঠিক ভেবে দেখে নি। যদি সুতো ছেড়ে দেয়, তাহলে সোজা পড়বে—ধপাস—আর সেটা মোটেই মজার হবে না। তাই ও অনেকক্ষণ ভাবল, আর ভেবে বলল:

"ক্রিস্টফার রবিন, তুমি বন্দুক দিয়ে বেলুনটাকে গুলি করতে পারো। তোমার কাছে বন্দুক আছে তো?"

"অবশ্যই আছে," তুই বললি। "কিন্তু গুলি করলে বেলুনটা নষ্ট হয়ে যাবে যে," তুই বলিস।

"কিন্তু না করলে," পু বলে, "আমাকে সুতো ছাড়তে হবে, আর আমি নষ্ট হয়ে যাবো।"

এরকম করে যখন বলল, তুই তখন সেরকম করে ভাবলি, আর বন্দুকটা নিয়ে খুব সাবধানে বেলুনের দিকে তাক করলি, আর গুলি চালালি।

"আউ!" পু চেঁচায়।

"লাগে নি?" তুই প্রশ্ন করিস।

"লেগেছে," পু বলে, "কিন্তু বেলুনে লাগে নি।"

"ওহো, ভুল করে হয়ে গেছে," বলে তুই আবার গুলি চালাস, আর এইবারে সোজা বেলুনে গিয়ে গুলি লাগে, ধীরে ধীরে বেলুন থেকে হাওয়া বেরিয়ে আসে, আর উইনি-তো-পু ভাসতে ভাসতে মাটিতে নেমে আসে।

কিন্তু এতক্ষণ ধরে বেলুন ধরে থেকে পু বেচারার হাতদুটো এতটাই আড়ষ্ট হয়ে গেছিল যে সারা সপ্তাহ ওর হাতদুটো শক্ত হয়ে আকাশের দিকে সোজা হয়ে রইল, আর যখনই কোনো মাছি ওর নাকে এসে বসত, ওকে ফু দিয়ে মাছিটাকে ওড়াতে হত। আর আমার মনে হয়—তবে স্পষ্ট জানি না—ফু দিয়ে ওড়াত বলেই ওর নাম পু।

"গল্প শেষ?" ক্রিস্টফার রবিন প্রশ্ন করে।

"এই গল্পটা শেষ। কিন্তু আরো গল্প আছে।"

"আমাকে আর পু-কে নিয়ে?"

"আর শুয়োছানা আর খগ্গো আর তোরা সক্কলে। তোর মনে নেই?"

"মনে আছে, কিন্তু মনে করার চেষ্টা করলে মাঝে মাঝে ভুলে যাই।"

"ঐ যে সেদিন পু আর শুয়োছানা হত্তিককে প্রায় ধরে ফেলেছিল——"

"ধরে ফেলে নি তো?"

"না।"

"পু ধরবে কী করে, ওর কোনো বুদ্ধিই নেই। আমি ধরেছিলাম কি?"

"সেটা গল্পে আছে, ক্রমশ প্রকাশ্য।"

ক্রিস্টফার রবিন মাথা নাড়ে।

"আমার মনে আছে," সে বলে, "কেবল পু-র অতটা মনে নেই, তাই ও আর একবার শুনতে চায়। তাহলে সেটা একটা গল্প হবে, শুধু মনে পড়া নয়।"

"আমারও সেটাই মনে হয়," আমি বলি।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ক্রিস্টফার রবিন ভালুকে তুলে দরজার দিকে এগোয়, পু সঙ্গে থাকে। দরজার মুখে দাঁড়িয়ে শেষ প্রশ্ন করে, "চানে যাচ্ছি, দেখতে আসবে?"

"আসতে পারি," আমি বলি।

"আচ্ছা, আমি যখন গুলি করেছিলাম, পু-র লাগে নি তো?"

"একেবারে না।"

মাথা নাড়তে নাড়তে সে এগোয়, আর খানিক‌ক্ষণ বাদে শুনতে পাই উইনি-তো-পু ওর পাশে পাশে—ধুপ্, ধাপ্, ধপাস্—করে সিঁড়ি দিয়ে উঠছে।

সূচী

পর্ব ২

যেখানে পু বেড়াতে গিয়ে একটা কঠিন পরিস্থিতিতে আটকে পড়ে

এডয়ার্ড ভালু, বন্ধুদের কাছে উইনি-তো-পু, বা ছোট করে পু, একদিন গুণগুণ করে গান গাইতে গাইতে অরণ্যের মধ্যে দিয়ে হাঁটছিল। গুণগুণ গানটা সেদিনই সে বানিয়েছিল, সকালের ব্যাম চলাকালীন: ট্রা-লা-লা, ট্রা-লা-লা, হাত ওপরে করতে করতে, আর তারপর ট্রা-লা-লা, ট্রা-লা—ওরে বাবা!—লা, হাত নীচু করে পা ছুঁতে ছুঁতে। সকালের খাবার খেয়ে একাধিকবার বলে বলে অভ্যেস করে নিয়েছে, এখন বেশ মুখস্ত হয়ে গেছে, তাই একটানা সুন্দর গাইতে পারছিল। অনেকটা এরকম:

ট্রা-লা-লা, ট্রা-লা-লা,
ট্রা-লা-লা, ট্রা-লা-লা,
রুম-টুম-টিডল-উম-টুম।
টিডল-ইডল, টিডল-ইডল,
টিডল-ইডল, টিডল-ইডল,
রুম-টুম-টুম-টিডল-উম।

তো এরকম করেই গাইছিল, আর বাকিরা কী করছে, বা বাকিদের মত হতে কেমন লাগে, এসব বিবিধ কথা ভাবতে ভাবতে বেশ ফুর্তিতে হাঁটছিল, তখনই হঠাৎই সামনে এসে পড়ল একটা নদীর তীর, আর নদীকুলে একটা বড় গর্ত।

"আহা!" পু বলে। (রুম-টুম-টিডল-উম-টুম।) "যদি আমি কোনো দিনও কোনো কিছুর ব্যাপারে কোনো কিছু জেনে থাকি, এই গর্তটা মানে খগ্গো," সে বলে, "আর খগ্গো মানে আড্ডা," সে বলে, "আর আড্ডা মানে খাওয়াদাওয়া আর আমার গুণগুণ গান শোনানো, ইত্যাদি, ইত্যাদি। রুম-টুম-টুম-টিডল-উম।"

তাই সে নীচু হল, গর্তে মুখ ঢোকাল, আর ডাকল:

"বাড়িতে কেউ আছে?"

গর্তের ভেতর থেকে একটা খসখস শব্দ, তারপর নিস্তব্ধতা।

"মানে যেটা বলছিলাম, 'বাড়িতে কেউ আছে?'" পু বেশ চেঁচিয়ে বলে।

"না নেই!" একটা আওয়াজ শোনা যায়; আরো শোনা যায়, "এত জোরে চেঁচানোর কোনো দরকার নেই। প্রথমবারেই যথেষ্ট ভালো শুনতে পেয়েছিলাম।"

"যাঃ!" পু বলে। "সত্যিই কেউ নেই?"

"কেউ নেই।"

উইনি-তো-পু গর্ত থেকে মুখ বার করে, একটু ভাবে, আর নিজেকে বোঝায়, "কেউ তো আছে, কারণ কেউ তো বলেছে 'কেউ নেই।'" তাই সে গর্তে আবার মুখ ঢুকিয়ে প্রশ্ন করে:

"খগ্গো, ওটা কি তুমি?"

"না," খগ্গো উত্তর দেয়, এবার একটু অন্য রকম গলা করে।

"কিন্তু ওটা তো খগ্গোর গলার আওয়াজ?"

"না তো," খগ্গো বলে। "মানে, হওয়ার কথা না তো।"

"ওহো!" পু বলে।

ও গর্ত থেকে মুখ বার করে, আবার একটু ভাবে, আবার মুখ ঢোকায়, আর বলে:

"আচ্ছা, খগ্গো কোথায় আছে সেটা বলতে পারবে কি?"

"সে ওর বন্ধু পু ভালুর সাথে দেখা করতে গেছে, সে ওর খুব ভালো বন্ধু।"

"কিন্তু সে তো আমি !" ভালু বলে, বেশ চমকে উঠে।

"কীরকম আমি?"

"পু ভালু।"

"তাই নাকি?" খগ্গো বলে, আরো বেশি চমকে।

"হ্যাঁ হ্যাঁ, একদম তাই," পু বলে।

"ওহো, তাহলে ভেতরে চলে এসো।"

তাই পু গর্তের মধ্যে ঠেসল আর ঠুসল, আর ঠেসেঠুসে শেষমেশ গর্তের ভেতর ঢুকল।

"ঠিকই বলেছিলে," খগ্গো বলে, পু ভালুকে ভালো করে নিরীক্ষণ করে। "এটা সত্যিই তুমি। দেখা হয়ে ভালো লাগল।"

"তুমি কাকে ভেবেছিলে?"

"ভাবি নি। জানো তো অরণ্যের ব্যাপার-স্যাপার। না জেনেশুনে যে কোনো কাউকে তো আর ঘরে ঢুকতে দিতে পারি না। সাবধানতার প্রয়োজন। কিছু খাবে?"

সকাল এগারোটা নাগাদ পু-র কিছু খেতে বেশ ভালোই লাগে, তাই খগ্গোর বাসনকোসনের তোড়জোড় দেখে পু খুশিই হল; আর তারপর খগ্গো যখন প্রশ্ন করল, "পাউরুটির সাথে মধু নেবে না দুধের সর?" পু এত খুশি হয়ে গেল যে সে বলে ফেলল, "দুটোই," আর তারপর, যাতে লোভী না মনে হয়, যোগ করল, "তবে পাউরুটি লাগবে না।" আর তারপর অনেকক্ষণ কিছু বলল না ... তারপর সব শেষে, একটু ভারী গলায় গুণগুণ করতে করতে উঠল, আর খগ্গোর হাতে হাত দিয়ে বলল এবার এগোতে হবে।

"যাচ্ছো?" খগ্গো সৌজন্যসূচক প্রশ্ন করে।

"মানে," পু বলে, "আর একটু থাকতে পারি —তুমি যদি——" আর খুব করুণভাবে ভাঁড়ারঘরের দিকে তাকায়।

"আদপে, ব্যাপারটা হল," খগ্গো বলে, "আমাকেও একটু বেরোতে হবে।"

"ওহ, আচ্ছা, বেশ তাহলে, আমিও এগোই। টাটা।"

"হ্যাঁ, টাটা। তুমি আর খেতে না তো?"

"আরো আছে?" পু সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন করে।

খগ্গো ঢাকনা খুলে ভালো করে দেখে বলে, "না, আর নেই।"

"আমিও তাই ভেবেছিলাম," মাথা নাড়তে নাড়তে পু বলে। "আচ্ছা, বেশ, টাটা। আমি এবার এগোই।"

তাই সে গর্ত দিয়ে বেরোতে শুরু করল। হাত দিয়ে টেনে আর পা দিয়ে ঠেলে শুরু করল সে, আর খানিকক্ষণ বাদেই বাইরে বেরোল তার নাক ... তারপর কান ... তারপর তার হাত ... তারপর কাঁধ ... আর তারপর——

"বাঁচাও!" পু বলে। "ফেরত যেতে হবে।"

"যাঃ বাবা!" পু বলে। "সামনেই এগোতে হবে মনে হচ্ছে।"

"কোনোটাই যে হচ্ছে না!" পু বলে। "বাঁচাও আর ধুত্তেরি!"

ইতিমধ্যে খগ্গোও বেরোবে ঠিক করেছিল, আর সামনের দরজা ভর্তি দেখে, সে পেছনের দরজা দিয়ে ঘুরে, পু-র সামনে এসে দাঁড়াল, আর এক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাল।